ছোটবেলায় মাদ্রাসায় বাংলা দ্বিতীয় পত্রে ভাব সম্প্রসারণ পড়তাম “শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড” তখন মুখস্ত করলেও প্রকৃত অর্থটা একটু পরে অনুধাবন করতে পেরেছি। মেরুদণ্ডহীন মানুষ যেমন অকল্পনীয়, ঠিক তেমনি শিক্ষা ছাড়া একটি জাতি কিংবা দেশ গঠনও অকল্পনীয়। তাই ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিক্ষা। যেমন পবিত্র কোরআন নাজিলের সর্বপ্রথম শব্দই হলো “ইকরা” অর্থ পড়। কারণ যতই একজন মানুষ অধ্যয়ন করবে, সে ততই বিদ্বান ও গবেষণার দিকে অগ্রসর হবে। অধ্যয়নের মধ্য দিয়েই মানুষ জ্ঞান, সহমর্মিতা, সম্প্রীতি, ন্যায়পরানতা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও মহান আল্লাহর অভিনব সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। মুসলিম মিল্লাতের আদি শিক্ষক স্বয়ং মহান আল্লাহ তায়ালা। তাই আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহর ওহীর মাধ্যমে বলেছেন, “পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, আলাক থেকে। পড়! তোমার রব মহান সম্মানিত, যিনি শিক্ষাদান করেছেন মানুষকে যা তারা জানতো না”। (সূরা আলাক : ১-৫)
তাই ইসলামে সবসময় জ্ঞান চর্চা ও গবেষণার জন্য মোটিভেশান দেয়া হয়েছে।
ফলস্বরূপ অধিক পঠিত ও গবেষণার ফলে মুসলিম ধর্মে রয়েছে সেরা সেরা মুসলিম বিজ্ঞানী। যদিও বর্তমান সময়ে বহির্বিশ্বের প্রপাগান্ডা মুসলিম নিধনের প্রচেষ্টা ও মুসুলমানদের অযোগ্যতা-অদক্ষতার ফলস্বরূপ সেই সোনালী ইতিহাস কিছুটা হলেও ধামাচাপার মত অবহেলায় পড়ে আছে। আজকালকার তরুণ প্রজন্মরা সেরা সেরা মুসলিম বিজ্ঞানীদের অনুসরণ না করে বিধর্মীদের বেছে নিচ্ছেন। অথচ একসময় গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা মুসলিম বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্যে ও সাহচর্যে ছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির পরপরই গোটা বিশ্বে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে। খোলাফায়ে রাশেদার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও প্রচেষ্টায় মুসলমানদের চারিদিকে জয়জয়কার অবস্থা। পাশাপাশি জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চাও তারা ব্যাপকভাবে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তৈরি হতে থাকে সেরা সেরা মুসলিম বিজ্ঞানী ও মনীষী। অত্যাধিক ধর্মতত্ত্ব অনুসরণের মাধ্যমেই তৈরি হয় এ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মবেত্তা, সেনাপতি, ইতিহাসবেত্তা, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, মনীষী, জ্যোতিষীশাস্ত্রবিদ, রসায়নবিদ, পদার্থবিদসহ নানা শাখার ব্যক্তিত্বগণ।
ইবাদতের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় সব সময় মগ্ন থাকতেন মুসলিম জাতি। আজ-কালকার পশ্চিমারা এবং বাঙ্গালীদের মধ্যে কতিপয় নামে বুদ্ধিজীবীরা মুসলিমদের অবদান অস্বীকার করলেও এ কথা স্বীকৃত যে পশ্চিমারা বা অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীরা আরব তথা মুসলিম বিজ্ঞানীদের কাছে চির ঋণী।
মানব জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আছে। কুরআনকে অনুধাবন করে মানবতার কল্যাণে মুসলিম বিজ্ঞানীরা অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তন্মধ্যে তাদের কিছু অবদানের দিকে নজর দেয়া যাক-
পদার্থবিজ্ঞান: ইসলামের ইতিহাসে প্রথম পদার্থবিজ্ঞানী হযরত আলী (রা.)। হযরত আলী (রা.) থেকেই আরব সভ্যতার বিজ্ঞান গবেষণার সূচনা হয়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত আলী (রা.) সম্পর্কে বলেন, আমি জ্ঞানের নগরী, আর আলী সেই নগরীর দরজা। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন হাফেজ ও মুফাসসির। আলবেরুনী, আল খারেজমি, ইবনুল হাইসামসহ আরও অনেক মুসলিম মনিষী পদার্থবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
চিকিৎসাশাস্ত্র: জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো চিকিৎসাবিজ্ঞান। জানা যায় যে, হযরত ইদ্রিস (আ.) হলেন প্রথম চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) হলেন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী। পবিত্র কোরআনে পাকের ৯৭ টি সূরার ৩৫৫ টি আয়াত চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট। বুখারীর হাদিসগ্রন্থে “তিব্বুন নববী” শীর্ষক অধ্যায়ে ৮০টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন মুসলিম মনীষী বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তাদের মধ্যে ইবনে সিনা, আল রাজি, আল কিন্দি, আত-তাবারী রুশদসহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
এদের মধ্যে ইবনে সিনা প্রখর মেধাবী ছিলেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে হাফেজ হন। তিনি দর্শনশাস্ত্র, অঙ্কশাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব ও ফিকাহ পড়তে ভীষণ পছন্দ করতেন। তার প্রিয় বিষয় ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্র। ইবনে সিনার সর্বপ্রথম ভার্ণিয়ার স্কেল আবিষ্কার করেন। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র দর্শন, অঙ্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, বীজগনিত প্রভৃতি জ্ঞানের শাখায় তার অপরিসীম প্রতিভার অবদান রাখেন। তার গ্রন্থ ও প্রবন্ধ সংখ্যা সর্বমোট ২৪৬ টি। অঙ্কশাস্ত্রের উপর ১১৯ টি, জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত ১১ টি, ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কিত ৬৮ টি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কিত ১৬ টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। পাশাপাশি তিনি ৯২ টি গ্রন্থের অনুবাদ করেছেন।
ওষুধশাস্ত্র: চিকিৎসার পাশাপাশি ওষুধ শাস্ত্রেও মুসলিমরা ব্যাপক অবদান রাখেন। ওষুধ তৈরী ও বিভিন্ন রোগের সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গেও বিভিন্ন বই লিখেছেন। যেমন- ইবনে সিনার “কানুন-ফিত-তিব্ব” আল রাজীর “কিতাবুল মানসুরি” আল বেরুনীর “কিতাব আস সায়দালা”।
চক্ষু চিকিৎসাশাস্ত্র: চক্ষু চিকিৎসাও রয়েছে মুসলমানদের মৌলিক অবদান। জর্জ সার্জন আলী আল মাওসুলিকে সর্বপ্রথম মুসলিম চক্ষু চিকিৎসক হিসেবে অকপটে স্বীকার করেছেন। এছাড়াও ইবনে হাইসাম, আল বেরুনী, আল ইবনে রাব্বান, হুনাইন ইবনে ইসহাকসহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা: হযরত মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধকালীন অবস্থায় যে হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন, তার উপর ভিত্তি করে মুসলিম শাসকগোষ্ঠী চিকিৎসা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গভেষণা ও ব্যবহারিক জ্ঞানচর্চার জন্য স্থায়ী হাসপাতাল গড়ে তোলেন।
অস্ত্রোপচার: মুসলিম বিজ্ঞানী আল রাজি সর্বপ্রথম অস্ত্রোপচার বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
গণিতশাস্ত্র: মুসলিম গণিত শাস্ত্রবিদদের মধ্যে রয়েছে আল খারেজমি, আল কারখি, ওমর খৈয়ামসহ প্রমূখ। এদের মধ্যে আল খারেজমি সংখ্যা বাচক চিহ্ন সম্পর্কে ধারণ দেন এবং দূরত্ব ও নির্ণয় বিষয়ে অবদান রেখেছেন ইবনুল হাইসাম।
এছাড়াও মুসলিম বিজ্ঞানী আল ফারাবি সমুদ্র ও সূর্যের উচ্চতা বিষয়ক যন্ত্র আবিষ্কার করেন।
রসায়ন: বিজ্ঞানের প্রাণ বলা হয় রসায়নশাস্ত্র। রসায়নশাস্ত্রের জনক বলা হয় জাবের ইবনে হাইয়ানকে। এছাড়াও বিভিন্ন মুসলিম মনিষী ও বিজ্ঞানী ব্যাপক অবদান রাখেন। এদের মধ্যে খালিদ বিন ইয়াজিদ, জাকারিয়া আল রাজি, আল জিলকাদসহ প্রমুখ। এগুলোর পাশাপাশি জাবির ইবনে হাইয়ান সর্বপ্রথম এসিড, গন্ধক, জল দ্রাবক, রৌপ্যক্ষার ও অন্যান্য যৌগিক বিষয়াবলি আবিষ্কার করেন।
ধাতুশাস্ত্র: মুসলিম বিজ্ঞানী ও মনিষী আবুল কাশেম আল ইরাকি সর্বপ্রথম ধাতুর পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা দেন।
ডিমের পানি প্রস্তুতকরণ: মুসলিম বিজ্ঞানী, বিখ্যাত রসায়নবিদ, ইমাম জাফর আস সাদিক সর্বপ্রথম রসায়নশাস্ত্রের আলোকে ডিমের পানি প্রস্তুতকরণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
জ্যোতির্বিদ্যা: জ্যোতির্বিদ্যা হলো মহাকাশ সম্পর্কিত বিজ্ঞান। গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র ও সূর্য সম্পর্কিত আলোচনা। এ বিষয়ে মুসলিম মনীষীদের অবদান অপরিসীম। এ বিষয়ে যারা অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে আল মনসুর, আল মামুন, আবু মাশার, আল খারেজমি, আবুল হাসানসহ আরও অনেকেই।
মানচিত্রের ধারণা: বিশ্বে প্রথম মানচিত্রের ধারণা দেন মুসলিম মনীষী আল ইদ্রিস পরবর্তীতে এর উপরে ভিত্তি করেই বিশ্বে মানচিত্রের প্রতিকৃতি হিসেবে স্বীকৃত হয়।
উদ্ভিদবিদ্যা: উদ্ভিদবিদ্যায় মুসলিমদের অবদান অতুলনীয়। উদ্ভিদের মধ্যে ইবনে বাতরের নাম উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও বর্ষপঞ্জি ও নক্ষত্র বিষয়ে ধারণা প্রণয়ন করেন ওমর খৈয়াম পরবর্তীতে আল বাত্তানী প্রথম চার্ট তৈরি করেন এবং প্রথম জ্যামিতিক গণনার সাহায্যে যে কোন দুটি স্থানের মধ্যে দূরত্ব নির্ণয় করেন বিজ্ঞান ও গনিত শাস্ত্রের অন্যতম মুখ ইবনুল হাইশাম।
মুসলিম জাতির মধ্যে অসংখ্য আবিষ্কার, গবেষণা, নির্মাণ ও বিজ্ঞানের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এক সোনালী ইতিহাস। আর এমন সোনালী ইতিহাস ইসলাম বিদ্বেষী ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে করেছে কিছুটা নিম্নগামী। তাই তরুণ প্রজন্মের কাছে শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইসলামের অবদানকে উপস্থাপন করতে হবে অভিনব পদ্ধতিতে। যাতে কারে মুসলিম জাতিদের মধ্যে বিন্দুমাত্র হতাশা ও দ্বিধায় না পড়তে হয়। মুসলিম এ সোনালী কৃতিত্ব ও অবদান যখন তরুণদের কাছে প্রচার ও প্রসার হবে তখন তারা বিধর্মী ও পশ্চিমাদের ছেড়ে অনুসরণ করবে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সাহাবিদের, মুসলিম বিজ্ঞানীদের, মুসলিম মনীষীদের এবং আলেমদের। তারা পশ্চিমা নায়ক-নায়িকাদের ছেড়ে গর্ব করে বলবে আমাদের একজন ইবনে সিনা আছে।
লেখক:
মনিরুল ইসলাম
প্রাবন্ধিক
ভুলবাকুটিয়া-সিরাজগঞ্জ