কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের মনু মিয়া। প্রায় ৩ হাজারের বেশি কবর খুঁড়ে নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে সহায়তা করেছেন এই ব্যক্তি। তিনি কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ হয়ে যখন তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তখন তার একমাত্র বাহক প্রিয় ঘোড়াটিকে মেরে ফেলে দুবৃত্তরা।
মনু মিয়াকে নিয়ে দেশের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে তা অনেককেই মর্মব্যথী করে তোলে। অনেকেই তার পাশে দাঁড়ানোর অভিপ্রায় জানান।
এই মর্মান্তিক ঘটনার খবর নজরে আসে জনপ্রিয় অভিনেতা খায়রুল বাসারেরও। তিনি গত সোমবার মনু মিয়াকে নিয়ে করা একটা সংবাদ প্রতিবেদন শেয়ার করে ক্যাপশনে লিখেন :
“মনু মিয়াকে আমি ঘোড়া কিনে দিতে চাই। বিনিময়ে আমার কবর খোঁড়া পর্যন্ত আল্লাহ উনাকে বাঁচিয়ে রাখুন। কেউ যদি মনু মিয়ার সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন, কৃতজ্ঞ থাকব।”
সেই সন্ধ্যাতেই হাসপাতালে অসুস্থ মনু মিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন খায়রুল বাসার। মঙ্গলবার নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে মনু মিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন তিনি। তিনি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন, মনু চাচা দোয়া ছাড়া কিছু চান না আপনাদের কাছে। উনি আপনাদের জন্য দোয়া করেন আপনারা ভালো থাকুন , সুন্দর থাকুন।
মনু চাচা বললেন ঘোড়ার জন্য তার কষ্ট নাই। কষ্ট নাই কারা তার ঘোড়াকে হত্যা করেছে তা নিয়েও। মনু চাচা মনে করেন তার ঘোড়ার সাথে তার যাত্রা এ পর্যন্তই রাখছেন আল্লাহ। ঘোড়াটার কপালে আল্লাহ সময় সীমা এই রাখছিলেন। বললেন সে মারা গেছে তো চোখে দেখি নাই তাই কষ্ট যেটুক হবার তাও হচ্ছে না। আসলে আর কতটা অভিনয় করলে সন্তানের প্রতি মায়া আড়াল করতে পারবেন; মনু চাচা ভেবে পাচ্ছেন না!
আবার জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ি ফিরে ওকে ছাড়া শূন্য শূন্য লাগবে না? বললেন ১০ মণ খড় আর ১০ মন কুড়া কিনেছিলেন ওর জন্য। অল্প খাইয়ে ঢাকায় এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। এই খড় কুড়া ওর রিজিকে থাকলো না , তার আগেই সে চলে গেলো! বাড়ি ফিরে এই খড় কুড়া দেখে কষ্ট হবে। বাড়ি ফিরে যে ঘোড়াটার জন্য কষ্ট হবে ; এই ভেবেই মনু চাচার চোখ ভিজে উঠলো! আমি একটু থামলাম। ভাবলাম কত আর শক্ত থাকা যায়! মায়া তো মনু চাচার আছে।
মনু চাচার অসুস্থতা বলতে ডায়বেটিস আর কোমর ব্যথা। কথাবার্তায় যা বুঝলাম খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম করেন খুব। ফজরের নামাজ পড়ে বেরিয়ে পড়েন উনার দায়িত্বে , জোহরের নামজ শেষে দাফন শেষ হয় , তারপর বাড়ি ফিরতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা বা রাত। সকালের নাস্তা বা দুপুরের খাবার খাওয়া হয় না। এমনটা প্রায়ই ঘটে, কারণ মৃত ব্যক্তির বাড়িতে উনি কখনও কিছু খান না। কবর খোঁড়া কাজে উনি কোনদিন কারো থেকে এক পয়সা নেন নাই। নিঃস্বার্থভাবে নিরলসভাবে উনি মানুষের প্রতি উনার মহৎ দায়িত্বটাকেই এগিয়ে রেখেছেন!
জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই ঘোড়াটা কতদিন ছিলো আপনার সাথে? উনি বললেন মুক্তির সময় থেকে উনি ঘোড়ায় চড়েন। ৭১-এ বয়স কত ছিলো জিজ্ঞেস করলে বললেন মুক্তিদের বয়সের সমানই। ১৩-১৪? হেসে বললেন বয়স তখন ১৭-১৮ই হবে মনে হয়। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম এই কাজ কবে থেকে করেন? উনিও হেসে বললেন তখন বাবাজি তোমরা জন্মও নাই।
মানুষের বাইক-সাইকেলের শখ থাকে। আমি যতটা বুঝলাম উনার শখ ছিলো হাতেম তাঈ হওয়া। মানুষের প্রোয়োজনে ঘোড়ার পিঠে চড়ে মানুষের দুয়ারে পৌঁছে যাওয়া। উনি উনার সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে মহৎ কাজটিই করে গেছেন আজীবন। উনি সুস্থ হয়ে আবার উনার শখের কাজে ফিরতে চান দ্রুত। আপনাদের দোয়ায় নিশ্চয়ই আল্লাহ উনাকে দ্রুত সুস্থ করে তুলবেন।
উনি কারো কাছে ঘোড়া চান না , দোয়া চান। উনার কারো প্রতি অভিযোগ – অনুযোগ নেই। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে প্রোয়োজনে ৭ টা ঘোড়া কিনতে পারবেন বলেছেন। যা হবার হয়ে গেছে , আল্লাহ যা নির্ধারণ করতে চান তাই হবে। উনি মনে করেন সবই নসিব।
কতটা কদর বুঝি আমরা এমন মানুষদের! কি প্রতিদান পেল এই মানুষটা? হাঁটছি আর ভাবছি…
“মুক্তার মালা গলায় দিয়ে ঘুরে কপাল পুড়া!
না কিনে উপায় কি কিনতে চাইলে ঘোড়া??
মনু মিয়ার ঘোড়া তার জীবন দিয়ে আমাদের সাথে এক নায়কের পরিচয় করিয়ে দিলো! আমাদের শেখা উচিত এই সমাজের মানবিক আদর্শ , সম্মান এবং গর্ব ” আমাদের মনু মিয়া “।