৩৬ জুলাই বা বাংলা বসন্ত অর্জিত হয়েছে অজস্র ত্যাগের বিনিময়ে। অন্ধকার যুগ থেকে আলোর মুখ দেখতে পেয়েছে এদেশের জনসাধারণ। তবে কিছু ভুল পদক্ষেপ এই কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে পারে। তাই শুধু ছাত্র-জনতাকে সচেতন হলে চলবে না, আপামর জনসাধারণকেও সতর্ক থাকতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে যেন কেউ অন্যায় স্বার্থ হাসিল করতে না পারে।
বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোনো কালেই এদেশের রাজনীতিতে সুষ্ঠু, সর্বজনগ্রহণযোগ্য পরিবেশ ছিল না। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এমন রাজনৈতিক পরিবেশ কোনো সভ্য সমাজের মানদণ্ড হতে পারে না। তাই প্রজ্ঞাবানরা বলেন, “আমরা স্বাধীন হয়েছি, সভ্য নয়।”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে একসময় এদেশে নেতৃত্বের সংকট দেখা দিতে পারে। সময় এসেছে অতীতের সকল গ্লানি মোচন করে নতুন রাজনৈতিক ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করার। যেখানে কোনো হিংসা বা প্রতিহিংসা থাকবে না। সবাই অহিংস নীতিতে বিশ্বাস করবে। রাষ্ট্রের আইন ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকবে এবং আইন চলবে নিজস্ব গতিতে। কেউ সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
বাংলাদেশে আমলাদের কাজে রাজনীতিবিদদের প্রভাব স্পষ্ট। তারা ব্যক্তি স্বার্থে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেন, যার ফলে আমলারা দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারেন না এবং পরবর্তীতে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সময়ের পরিক্রমায় যে সরকারই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বিভিন্ন মতাদর্শের উপর দমন-পীড়ন ও হামলা-মামলার নীতি চালু করা। এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অতীত ইতিহাস সুখকর নয়।
সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্য নিরসনের দাবিতে সারা দেশে ব্যাপক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। এর ফলে ঝরে গেছে অজস্র প্রাণ। এ আন্দোলন বাংলাদেশের ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬ এর ছয় দফা, এবং ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের চেয়েও বৃহৎ। স্মরণকালের অন্যতম বড় গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতা আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে—বাংলাদেশের রাজনীতি কি অতীতের পথে যাবে, নাকি নতুনত্বের দিকে এগোবে? অতীতের পথে গেলে এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সাফল্য অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ধাবিত হবে। এর ফলে আবারও “হাওয়া ভবন” ও “আয়না ঘর”-এর মতো অন্য কোনো অন্ধকার অধ্যায় তৈরি হতে পারে।
তাই সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে সহমর্মিতা, পারস্পরিক সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা এবং সম্প্রীতি বজায় রাখা আবশ্যক। এতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সুন্দর পথে পরিচালিত হবে। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি মুক্ত সমাজ গঠনের জন্য প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। যোগ্য ও মেধাবীদের রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োগ দিয়ে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার থেকে মুক্ত করতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি অঙ্গকে সরকারের প্রভাবমুক্ত করা জরুরি। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। নোংরা রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বমানের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিরোধী দলগুলোকে গঠনমূলক সমালোচনায় মনোযোগী হতে হবে। ভালো কাজকে স্বীকৃতি এবং মন্দ কাজকে বিরোধিতা করতে হবে। একমাত্র সদিচ্ছার মাধ্যমেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন সম্ভব।
লেখক
জাহাঙ্গীর আলম অপূর্ব
সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ, সিরাজগঞ্জ।